অধুনাকালের ইতিহাসে ইখওয়ানের মতো নিপীড়ন-নির্যাতনের শিকার হওয়া কোনো দলের কথা আমি জানি না। ইখওয়ান চরম নির্মমতার শিকার হয়েছে। অদ্ভুত ব্যাপার হলো— এই দলটি একই সময়ে বিপরীতধর্মী দুই বিষয়েই অভিযুক্ত হয়েছে। এমন হাস্যকর ও বিদঘুটে অভিযোগ-অপবাদ দেখে যে কোনো পাঠক-পর্যবেক্ষকই অবাক হবেন। এক দল বলে ইখওয়ানের এই সমস্যা। অন্য দল ঠিক তার বিপরীত কথা বলে। কিন্তু ইখওয়ান এসব অপবাদকে উপেক্ষা করে চলে।
.
কিছু প্রগতিশীল দল আছে। তারা মনে করে, ইখওয়ান পশ্চাৎপদ ও স্থবির। সমগ্র জাতিকে পিছিয়ে দিচ্ছে। অতীত ও প্রাচীনকে আঁকড়ে ধরে আছে। কিছু ইসলামি চিন্তাবিদ ও লেখক মনে করে, ইখওয়ান মুহাম্মাদ আবদুহু এবং আফগানির পরে সংস্কার আন্দোলনের কারণে অধপতিত হয়েছে। এই আন্দোলন তাদের আরও রক্ষণশীল করে তুলেছে!
.
আবার কিছু ধর্মীয় শ্রেণির অভিযোগ এর পুরোই বিপরীত! তারা এবং তাদের অনুসারীরা ইখওয়ানকে বলে অতি উদারপন্থি, মডারেট, দ্বীনি বিষয়ে শিথিলতা প্রদর্শনকারী ইত্যাদি। এছাড়াও অনেকে ইখওয়ানের ইজতিহাদি চিন্তার সমালোচনা করে। ইখওয়ানকে প্রচলিত মাযহাব অমান্যকারী এবং নতুন নতুন মতের প্রবক্তা ইত্যাদি অভিধায় অভিষিক্ত করে।
.
সুফি ঘরানার কেউ কেউ ইখওয়ানকে মনে করে, ওহাবি চিন্তাধারার মানসসন্তান এবং ইবনে তাইমিয়া ও ইবনুল কাইয়িমের অন্ধ অনুসারী। অনেকে তো ‘সালাফি’ পর্যন্ত বলে। আর তারা মনে করে, ইখওয়ান সুফিদের জানের শত্রু।
.
অথচ সালাফিরা বলে ইখওয়ান সুফি তরিকাই প্রভাবিত বিদআতি। কারণ, হাসান আল বান্না সুফি ঘরানায় বেড়ে উঠেছেন। তিনি তাওয়াসসুলকে জায়েয মনে করেন। অথচ এই ব্যাপারটা দুআর ধরণ ও প্রকৃতি সংক্রান্ত, আকিদা সংক্রান্ত কোনো বিষয় নয়!
.
রাজনৈতিক দল এবং ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলো মনে করে, ইখওয়ান একটা ধর্মীয় দল— যারা রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েছে এবং ক্ষমতায় যেতে চায়! তারা মনে করে, ইখওয়ানের রাজনীতিতে লিপ্ত হওয়া এবং বিভিন্ন দলের সাথে ক্ষমতায় যাওয়ার প্রতিযোগিতা করা ইখওয়ানের উচিৎ নয়। এই কাজ কোনো ধর্মীয় দলের পক্ষে শোভা পায় না।
.
অথচ অন্যান্য ইসলামি দল মনে করে, ইখওয়ান যথাযথরূপে রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হয়নি। ক্ষমতায় যেতে জাতি এবং শক্তির পূর্ণ ব্যবহার করেনি। তাগুতি শক্তির হাত থেকে ক্ষমতা ছিনিয়ে নেওয়ার জন্য আইন ও শক্তির পূর্ণ ব্যবহারে ইখওয়ান ব্যর্থ।
.
বাদশাহ ফারুক, তার পরিষদবর্গ এবং সরকারের কাছে ইখওয়ান চরমপন্থি বিদ্রোহি দল। সামন্তবাদীরাও এমনটা মনে করে। তারা মনে করে, এই চরমপন্থি দল বাদশাহ, ধণিকশ্রেণি, সামন্তবাদী এবং প্রভাববিস্তারকারী পুঁজিবাদী সবার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। এছাড়াও দেশের দুর্বল ও সর্বহারা শ্রেণি কৃষক, শ্রমিক, মজুর ও মুঠেদের সামন্তবাদী ও পুঁজিবাদীদের বিরুদ্ধে উসকে দিয়েছে। ইখওয়ান প্রচলিত শাসনপদ্ধতির বিরুদ্ধে কাজ করছে। এই অভিযোগে ইখওয়ানের অজস্র কর্মীর বিরুদ্ধে তারা মামলাও দায়ের হয়েছে।
.
অন্যদিকে বামপন্থি ও সমাজতান্ত্রিক ঘরানার লোকদের কাছে ইখওয়ান একটি ডানপন্থি দল। দাম্ভিক শাসকশ্রেণি, সামন্তবাদী ও বাদশার মিত্র। অথচ এই শাসকশ্রেণির হাতেই ইখওয়ান অমানুষিক নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হয়েছে। অনেক কর্মী জীবন বিলিয়ে দিয়েছে এবং দ্বীনের পথে হয়েছে শহিদ। এমনকি ইখওয়ানের প্রতিষ্ঠাতাও তাদের বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে। এসব বামদলগুলোর তা চোখে পড়ে না। এই ব্যাপারে তারা অদ্ভুতভাবে নীরব।
.
ইসলামি কাজের সাথে যুক্ত বিভিন্ন শ্রেণির দৃষ্টিতে ইখওয়ান মডারেট বা শিথিলতাকারী। তাদের মতে, ইখওয়ান দ্বীনের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি পর্যায়ের শিথিল। আবার এর বিপরীত দলও আছে। তাদের কেউ মুসলিম আবার কেউ অমুসলিম। তারা বলে, ইখওয়ান ধর্মীয় ব্যাপারে বেশ কড়াকড়ি ও বাড়াবাড়ি করে। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলে না। অগ্রগতি ও উন্নতির জন্য সংস্কার করতে তারা রাজি নয়; ছাড় দিতে প্রস্তুত নয়।
.
এছাড়াও সরকারি টিভি চ্যানেল, মিডিয়া প্রচার করে ইখওয়ান একটা সন্ত্রাসী ও চরমপন্থি দল। তারা রক্তপাতে বিশ্বাস করে। এই অপপ্রচার চালাতে তারা নানা রসাত্মক চুটকিরও আশ্রয় নেয়। মিশরে ইহুদি ও ইংরেজদের স্বার্থের বিরুদ্ধে ইখওয়ানের কর্মীরা সংগ্রাম করেছে। এতে কিছু হামলা ও দুর্ঘটনাও ঘটেছে। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে ইখওয়ানের কিছু কিছু কর্মী কোথাও কোথাও হস্তক্ষেপ করেছে। যেমন— খাজানদার মার্ডার। এই ঘটনাগুলোকে পুঁজি করে তারা ইখওয়ানকে সন্ত্রাসী ও চরমপন্থি দল অ্যাখ্যা দিতে চায়।
.
আবার কিছু ইসলামি দলের দাবিদার আছে, যেমন— সালেহের গোপন দল, মুস্তফা শুকরির দল। এছাড়াও নিজেদের জিহাদি বলে পরিচিতি দানকারী এমন নানা দল মিশরের পটভূমিতে তৈরি হয়েছে। এই দলগুলো ইখওয়ানকে দুর্বল ও নিস্ক্রিয় ভাবে। জিহাদের মূল ভিত্তিকে অস্বীকারকারী মনে করে। অথচ ইখওয়ানের প্রতিষ্ঠাই হয়েছে জিহাদের ওপর। ইখওয়ানের স্লোগানই হলো— ‘জিহাদ আমাদের পথ, শাহাদাত আমাদের স্বপ্ন।’
.
প্রচ্ছদ প্রকাশন থেকে প্রকাশিতব্য বই— “ইখওয়ানুল মুসলিমিনের ইতিহাস” থেকে।
খবর সম্পর্কে মন্তব্য করুন