শায়খ ড. ইউসুফ আল কারজাভি পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন। সমগ্র মুসলিম উম্মাহ আজ একজন দরদী অভিভাবক হারিয়ে ফেলল। উম্মাহর জন্য তিনি ছিলেন এক সৌভাগ্যের বারতা। তাঁর দীর্ঘ জীবনকে হেয়ালি করে কাটাননি তিনি। বরং যাপন করেছেন অর্থপূর্ণ এবং ভীষণ প্রোডাক্টিভ এক জীবন। তিনি বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে মুসলিম উম্মাহকে এত বহুবিধ খেদমত দিয়েছেন, যা সমসাময়িক দুনিয়ার খুব কম স্কলারের পক্ষেই সম্ভব হয়েছে। ইসলামের প্রায় সকল শাখাতেই তাঁর লেখনী এবং বক্তৃতা আমাদের পথনির্দেশনা দিয়েছে। তাঁর লেখা বইগুলো যেন একেকটি জ্ঞানের সিন্ধু!
যে বয়সে তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন, তাকে একার্থে দীর্ঘ জীবনই বলা যায়। তবুও কী তীব্র এক যন্ত্রণা এসে জায়গা করে নিয়েছে বুকের গহীণে! প্রায় এক শতক পৃথিবীতে থেকেছেন তিনি। একজন দাঈ হিসেবে সম্ভব সবটুকো খেদমত দিয়েছেন উম্মাহকে। রেখে গেছেন হাজার বছরের দিকনির্দেশনা। আল্লাহ তাঁর সবটুকু কাজ কবুল করুন।
সাধারণত আল্লাহর নীতি হলো- উম্মাহর জন্য যখন যেমন ধরণের নেতৃত্ব প্রয়োজন, তিনি তেমন নেতৃত্বই পাঠান। এই সময়ের উম্মাহর মধ্যে বুদ্ধিবৃত্তিক একটা বিরাট দৈন্যতা বিরাজ করছিল। আল্লাহ ড. কারজাভির হাত দিয়ে কয়েক শত বই এবং নিবন্ধ লিখিয়ে নিয়েছেন; যা পৃথিবীর অসংখ্য ভাষায় অনূদিত হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বময়।
লেখালেখির ভূবনে এত বহুমুখী অবদান খুব বেশি চোখে পড়ে না। ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা ইমাম ইবনে তাইমিয়াকে এমন দেখতে পাই। আল্লাহ তায়ালা ইমাম ইবনে তাইমিয়াকে ছয় দশকের হায়াত দিয়ে করিয়ে নিয়েছেন ছয় লক্ষ বছরের কাজ। ড. কারজাভি যেন শায়েখ ইবনে তাইমিয়া (রাহি.)-এর চিন্তাদুনিয়ারই একজন যোগ্য ধারক!
আরব বিশ্বের ইসলামী আন্দোলনের দিকপাল শহীদ ইমাম হাসান আল বান্নার দুই প্রিয় শিষ্যের একজন ছিলেন ড. ইউসুফ আল কারজাভি। অপরজন ড. সাঈদ রমাদান; পরবর্তীতে যিনি ইমাম বান্নার বড় মেয়ে ওয়াফা আল বান্নার স্বামী হবার সৌভাগ্য লাভ করেন। আর ড. কারজাভি হয়ে ওঠেন তাঁর প্রতিষ্ঠিত আন্দোলনের থিংক ট্যাংক।
শায়খ কারজাভির শিক্ষাজীবন কিছুটা বিলম্বিত হয়েছিল। ১৯৬০ সালে যখন তিনি বিখ্যাত আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের কুরআন ও সুন্নাহ বিভাগ থেকে মাস্টার্স সম্পন্ন করেন, তখন তাঁর বয়স ৩৪ বছর। এরপরে রাজনৈতিক নানাবিধ জটিলতায় পিএইচডি করতে সময় লেগে যায় আরও ১৩ বছর। পিএইচডি শেষ করে যখন তিনি ডক্টর হয়ে উঠেছেন, তখন বয়স গিয়ে পৌঁছেছে ৪৭-এ।
তাঁর শিক্ষাজীবন থেকে শিক্ষা হলো- জীবনে পিছিয়ে পড়া মানেই সব শেষ হয়ে যাওয়া নয়। কখনও কখনও এই পিছিয়ে পড়াটাও হয়ে উঠতে পারে জীবনের বড় সুযোগের পথ অবমুক্ত হবার একটি দ্বার। ড. কারজাভির বন্ধুরা হয়তো তাঁর অনেক আগেই পিএইচডি শেষ করেছিলেন। তাদের কয়জনের নাম দুনিয়া জানে?
তাঁর জীবনের আরেকটি দিকের প্রতি আমি দৃষ্টিপাত করতে চাই। ইখওয়ানের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হবার অপরাধে তাঁকে কাতারে নির্বাসন দেয়া হয়েছিল। এই নির্বাসনই কিন্তু আশীর্বাদ হয়ে উঠেছিল তাঁর জীবনে! ঠিক যেমন তাঁর কয়েক সহস্র বছর আগে মিশরের কারাগার আশীর্বাদ হয়ে উঠেছিল আল্লাহর প্রিয় নবি হযরত ইউসুফ (আ.)-এর জন্য।
ড. কারজাভিকে কাতার বরণ করে নিলো গভীর ভালোবাসা আর শ্রদ্ধায়। তিনি কাতার বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের চেয়ারম্যান এবং শরিয়াহ ফ্যাকাল্টির ডিন হিসেবে একজন পুরোদস্তুর একাডেমিশিয়ান হয়ে উঠলেন। ১৯৯৬ সালে কাতার ভিত্তিক চ্যানেল আল জাজিরাতে ‘শরীয়াহ ও জীবন’ অনুষ্ঠান পরিচালনা করার মধ্য দিয়ে তিনি চলে এলেন আরও তুমুল আলোচনায়।
ইসলামী আন্দোলনের ভবিষ্যত নেতৃবৃন্দের জন্য তাঁর জীবনের আরেকটি দৃষ্টিভঙ্গি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করি। তিনি বিশ্বব্যাপী বহুসংখ্যক গবেষণা সংগঠন, সামাজিক সংগঠন, ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেছেন। শতাধিক বই, গবেষণাপত্র, আর্টিকেল ও মতামত লিখেছেন। অনেক নামী ম্যাগাজিনে ছাপা হয়েছে তাঁর লেখা। বক্তব্য রেখেছেন শত শত বিশ্ববিদ্যালয়, সেমিনার ও সিম্পোজিয়ামে।
ছিলেন ইখওয়ানের সবচেয়ে বড়ো পরামর্শক ও আধ্যাত্মিক নেতা। কিন্তু যখন তাঁকে ইখওয়ানের মুর্শিদে আমের জন্য প্রস্তাব করা হলো, তখন তিনি সচেতনভাবেই তা প্রত্যাখ্যান করে তাত্বিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক জগতেই থাকতে চাইলেন। তিনি মুর্শিদে আমের দায়িত্ব কাঁধে নিলে কি বুদ্ধিবৃত্তিক দুনিয়ায় এত বিরাট অবদান রাখা তাঁর পক্ষে সম্ভব হতো? তিনি চিনতে পেরেছিলেন তাঁর কাজের ক্ষেত্র।