[৩য় পর্ব]
তাড়াতাড়ি বা দ্রুততার সাথে সবকিছু করাটা একদিকে সবই হারাবেন, আর এটা অজ্ঞতার পরিচায়কও; কেননা এর অর্থ হলো আপনার সুন্নাহ বিষয়ে জ্ঞান নেই বা জ্ঞান থাকলেও এই ইলমের প্রতি খিয়ানত করছেন – সবদিক থেকেই আপনি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। নিচের হাদীসটি দেখুন,
“যে ব্যক্তি ইমামের পূর্বেই মাথা উঠায় তার কি এ ভয় করে না যে, আল্লাহ তা’আলা তার মাথাকে গাধার মাথায় রূপান্তরিত করে দিবেন।”
[মুসলিম ১/৩২০-৩২১]
কেন গাধার সাথে এমন ব্যক্তির তুলনা? কারণ গাধার জ্ঞান নেই, আর তাই সে তার অজ্ঞতার কারণে পরিষ্কার পানিকে ঘোলা করে পান করে, যা আদতে আরো ক্ষতিকর হয়ে যায়। তেমনি ধীর-স্থিরতার সুন্নাতে আমরা প্রশান্তি, খুশু, অধিক সাওয়াব, আল্লাহর নৈকট্য, নামাজকে সহজ মনে হওয়া ইত্যাদি সবই পাবো। এর বিপরীতে চোরের মতো দ্রুত, ক্ষুধার্তের মতো তাড়াতাড়ি, গাধার মতো আগে উঠবস, কাকের মতো ঠোকর, নামাজে চুরি ইত্যাদি ওসবই নষ্ট করবে।
নিম্নোক্ত হাদীসটি লক্ষ্য করুন, আমরা যেখানে ইমামের সাথে সাথেই রুকু বা সিজদাতে যাই সে সম্পর্কে। বারা’ ইবনে আযেব (রা) বলেন:
তারা রাসূল ﷺ এর পিছনে নামাজ পড়তেন। যখন রাসূল ﷺ রুকু হতে সিজদায় যেতেন তখন তিনি মাটিতে তাঁর কপাল না লাগানো পর্যন্ত আমাদের কেউ পিঠ নিচু করত না (সিজদা করার জন্য ঝুঁকতাম না)। (মাটিতে মাথা লাগানোর পর) আমরা সবাই সিজদায় যেতাম। [সহীহ মুসলিম: ৪৭৪]
অথচ আমরা ইমামের সাথে সাথেই রুকু-সিজদায় যাওয়া শুরু করি। এগুলো অজ্ঞতার শামিল, সুন্নাহর বিপরীত।
বাস্তব অভিজ্ঞতা এই যে, রুকু, সিজদা ইত্যাদি জায়গায় তাসবিহগুলো অবশ্যই ক্রমাগতভাবে বৃদ্ধি করতে থাকুন। তিনবার করে তো পড়েই থাকেন, সেখানে বৃদ্ধি করতে থাকুন। ধীরে ধীরে ৫ বার, ১০ বার, ২০ বার করতে থাকুন। যতো ইচ্ছা লম্বা করতে থাকুন রুকু বা সিজদা এবং অন্যান্য অংশগুলো। ধীরে ধীরে পড়ুন, সুন্দর করে, প্রত্যেকটা তাসবিহ পৃথকভাবে, তারতিলের সাথে, অন্তরের গভীর থেকে আপনার পঠিত তাসবিহর অর্থ ও গুরুত্বের কথা চিন্তাভাবনা করে পড়তে থাকুন, বৃদ্ধি করতে থাকুন ক্রমাগত – নিশ্চিত থাকুন আপনার পূর্ব জীবনের সমস্ত নামাজের চেয়ে এর প্রশান্তি আপনি তুলনাও করত পারবেন না।
এভাবে রুকু, সিজদাহ, তিলাওয়াত ইত্যাদি বৃদ্ধি করতে থাকুন। আল্লাহকে আপনি যতো বেশি সময় দেবেন তিনি আপনার কাছে ততো বেশি প্রিয় হয়ে উঠবেন। আপনি আল্লাহকে যতো ভালোবাসবেন এবং তাঁর জন্য নামাজে অবস্থান করবেন, তার গুণকীর্তন ও প্রশংসা করবেন এবং তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ হবেন, আল্লাহও আপনার জন্য ততোটাই নয় বরং আরো অধিক এগিয়ে আসবেন, অধিক ভালোবাসবেন।
রাসূল ﷺ রুকুতে পড়তেন,
سبحان ربي العظيم
সুবহানা রব্বিয়াল ‘আযীম
“আমার রব-প্রতিপালক মহান আল্লাহর পবিত্রতা বর্ণনা করছি, যিনি সকল দোষ-ক্রুটি থেকে মুক্ত” [সহীহ আত-তিরমিযী ১/৮৩]
আবার নিম্নের তাসবিহটি ১০ বার পড়তেন,
سُبْحَانَكَ اللَّهُمَّ رَبَّنَا وَبِحَمْدِكَ اللَّهُمَّ اغْفِرْ لِي
সুবহানাকা আল্লাহুম্মা রব্বানা ওয়া বিহামদিকা আল্লাহুম্মাগফিরলী
“হে আল্লাহ! আমাদের রব। তোমার পবিত্রতা ঘোষণা করি, তুমি সমস্ত ক্রুটি থেকে মুক্ত, পবিত্র, আর তোমার প্রশংসা করছি। হে আল্লাহ তুমি আমাকে মাফ করে দাও।” [সহীহ বুখারী ১/৯৯, সহীহ মুসলিম ১/৩৫০]
কেবল দশবারই নয়, এর চেয়েও আপনি বেশি করতে পারেন। ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,
“রাসুলুল্লাহ ﷺ এর নামাজের বিভিন্ন অংশের মধ্যে স্বাভাবিকতা ও সামঞ্জস্য বজায় থাকতো। তিনি যখন (নামাজের) কিয়াম (দাঁড়ানো অবস্থায় তিলাওয়াত-কিরাআত) লম্বা করতেন (দীর্ঘ সময় নিয়ে নামাজ পড়তেন) তখন স্বাভাবিকভাবে রুকু সাজদাও লম্বা করতেন। আবার যখন কিয়াম সংক্ষিপ্ত করতেন (দ্রুত নয় অবশ্যই), তখন রুকু সাজদাও সংক্ষিপ্ত করতেন”।
মা আয়েশা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা)-সহ অনেক সাহাবীর এমন বর্ণনা পাবেন, যেখানে রাসূলের দীর্ঘ সিজদার কারণে মনে করতেন যে তিনি মনে হয় সিজদা থেকে উঠতে ভুলে গেছেন বা মারা গেছেন! অর্থাৎ রাসূল ﷺ আল্লাহকে প্রিয় করে পাওয়ার জন্য এতটা নিমগ্ন থাকতেন। সালাতে থাকা মানে তো আল্লাহর সাথে থাকা, তার সাথে কথা বলা, আর তিনি এ সুযোগ ছাড়তেই চাইতেন না। সেজন্য তিনি রুকু-সিজদাও দীর্ঘ করতেন।
এই লেখায় একটা বিষয় লক্ষ্য করবেন, নামাজের মনোযোগের কম-বেশির কারণে সাওয়াবের তারতম্য হতে পারে কিন্তু রুকু, সাজদাহ, দুই সিজদাহ ইত্যাদির মাঝখানে আপনি যদি ধীর-স্থিরতা অবলম্বন না করেন তবে আপনার নামাজই হবে না। এরূপই রাসূল ﷺ এর প্রতি ওহী এসেছে এবং রাসূল ﷺ একজনকে তার নামাজ বাতিল ঘোষণা করে তিনবার নামাজ পড়িয়েছেন এবং সাহাবারাও এই নামাজকে ইসলামের অংশ মনে করতেন না।
[বই : কিভাবে নামাজের মধুরতা লাভ করা যায়? – মিশারী আল-খারাজ] বইটি অনলাইনে পাবেন ইনসাফ শপ বিডিতে
খবর সম্পর্কে মন্তব্য করুন